বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০১৩

স্কিজোফ্রেনিয়া



স্কিজোফ্রেনিয়া এমন একটি মানসিক রোগ যা আমাদের আশেপাশে যেকোন মানুষের ভেতরে থাকতে পারে। সে আপনার সব থেকে কাছের বন্ধু হতে পারে, সে আপনার ভাই-বোন হতে পারে, আপনার অফিসের কলিগ হতে পারে, এমনকি আপনার জীবনসঙ্গীও হতে পারে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই রোগ যার হয় সে ধরতেই পারেনা, আর ধরতে পারলেও চিকিৎসা করাতে চায়না।কিছুটা ভয় থেকে, কিছু অবজ্ঞা ও অবহেলা থেকে।


আগেও একবার বলেছি,আমাদের দেশে হৃদরোগ থেকে শুরু করে অন্যান্য শারীরিক জটিল ব্যাধির জন্যে আমরা যে পরিমাণ চিন্তিত হয়ে পড়ি, কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য বলে যে কিছু একটা আছে আমরা একেবারেই ভুলে যাই। স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রুগী সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে বিভিন্ন রকম সমস্যার সম্মুখীন হন, যেটা আস্তে আস্তে তার জগতকে আর সবার থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করে দেয়। এই রোগের ভয়াবহতা একেক রুগীর ক্ষেত্রে একেকরকম হয়। একটা সময় ধারণা করা হত যে স্কিজোফ্রেনিয়া বেশীরভাগ টিনেজারদের এবং ১৯-২৩ বয়সীদের হয়ে থাকে। কিন্ত এখন সে ধারণা পাল্টে গিয়েছে। এ রোগ যেকোন বয়স ও পৃথিবীর যেকোন প্রান্তেই হতে পারে। অনেকে মনে করে স্কিজোফ্রেনিয়া আর “ডুয়েল পারসোনালিটি/ দ্বৈত সত্ত্বা” একই রোগ। আবার অনেকের কাছে এদুটো সম্পূর্ণ আলাদা। এই বিষয়টা এখনও যুক্তি তর্কের মধ্যেই থেকেই গিয়েছে।

স্কিজোফ্রেনিয়া কি? 
একটি মানসিক রোগ যেখানে আক্রান্তদের সাথে ঘন ঘন কয়েকটি ব্যপার ঘটে।
বিভ্রম
হেলুসিনেশান
কল্পনার রাজ্যে বিচরণ
স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত মানুষ এমন একটা জগতে বাস করে যার বাস্তবে কোনও অস্তিত্ব নেই। তারা সেই জগতে স্বাভাবিক থাকে, কিন্তু বাস্তবে ফেরার সাথে সাথে তারা সেই স্বাভাবিকতা ধরে রাখতে পারেনা ( অন্যদের কাছে )।
লক্ষণঃ 
বিভ্রমঃ 
এটা হচ্ছে প্রথম লক্ষণ। স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত মানুষ একটা কল্পনার জগতে বাস করে, বাস্তবে যার কোনও অস্তিত্ব নেই। কিন্তু সেটাকে সে ব্যাখ্যা করতে পারেনা। সে কল্পনা করে তার আশেপাশে সবসময় কিছু না কিছু ঘটছে। কিন্তু সেই কল্পনার জগতে, বাস্তবে যার অস্তিত্বই নেই। সে আশেপাশের সবাইকে বলে সেখানে কি হচ্ছে, সবাইকে বিশ্বাস করাতে চায়। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করে না। করবে কিভাবে? সে যা দেখছে, ঘটছে তার চারপাশে, সেটা তার কল্পনার জগত। যেটাকে সে বাস্তব ধরে নিচ্ছে। তার আশেপাশের মানুষরা, এমনকি বাবা মা, ভাই বোনের কাছে তার এই অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে। কিন্তু কেউ তেমন গুরুত্বের সাথে নেননা। মনে করেন তেমন জরুরী কিছু না। সুস্থ সবলতো আছে তার সন্তান। ঠিক মত হাঁটা চলাফেরা করছে,এর বেশী আর কি? কিন্তু ভেতরে ভেতরে মানুষটা সেই কল্পনার জগতেই থেকে যায়। যেই সুখ সে বাস্তবে পায়না, সেটা সে তার কল্পনার জগত থেকে নিয়ে ঠিকই পায়।
হেলুসিনেশানঃ 
হেসুসিনেশান হচ্ছে দ্বিতীয় লক্ষণ। এক্ষেত্রে যা হয় আক্রান্ত মানুষটার মনে হয় তার চারপাশে কেউ চিৎকার করছে, কেউ তার নাম ধরে ডাকছে, অথবা এমন কোনও ঘ্রাণ/গন্ধ পায় যেটার বাস্তবে কোনও অস্তিত্ব নেই। যেমন একটা খাবারের ঘ্রাণ পাচ্ছে, যেটা আশে পাশে নেই। কিন্তু সে পাচ্ছে, পাশের আরেকজকে সেটা যখন বলে সেই মানুষটা বিশ্বাস করেনা। কারণ বাস্তবে এমন কোনও খাবার নেই সেখানে। সে দেখতে পায় একটা ঘটনা ঠিক তার সামনেই ঘটছে আর সেকেন্ডের মধ্যে সেটা উধাও হয়ে যায়, যেটা আসলেও ঘটেইনি বাস্তবে। মাঝে মাঝে সে কাল্পনিক চরিত্র তৈরি করে নেয় যার সাথে সে কথা বলে, তার এটাও মনে হয় কাল্পনিক চরিত্র/চরিত্রগুলো তাকে সব সময় অনুসরণ করছে।
কারণ ছাড়া হেসে ওঠা/কেঁদে ফেলাঃ 
এটা হচ্ছে তৃতীয় লক্ষণ। স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত মানুষ কোনও কারণ ছাড়াই হঠাৎ হঠাৎ হেসে ফেলে আবার কেঁদেও দেয়। যখন হাসার কথা তখন হাসছে না, কিন্তু যখন দরকার না তখন হাসছে। বড় ধরণের কোনও দুর্ঘটনায় এরা প্রতিক্রিয়া দেখায় না। নির্লিপ্ত থাকে। অতিরিক্ত দুঃখ, সুখ এরা বুঝতে পারেনা।
চিন্তাশক্তি বৃদ্ধিঃ 
চতুর্থ লক্ষণ। আক্রান্ত মানুষের চিন্তা শক্তি আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের চিন্তাশক্তি থেকে অনেক বেশী থাকে। এরা কল্পনা করে এমন সব কিছু করে ফেলে যা অন্য কেউ কল্পনাই করতে পারেনা। তারা কল্পনায় তাদের আলাদা একটা পৃথিবীই তৈরি করে ফেলে যেখানে সব কিছু করতে পারে তারা। সাধারনত এরা খুব মেধাবী হয়।
এখন আসি স্কিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা নিয়ে। এটার চিকিৎসা আছে। কিন্তু সেটা নির্ভর করছে রোগটি কোন পর্যায়ে রয়েছে তার ওপরে। অবশ্যই এটা আগে জানা দরকার, কারণ সেটার ওপরেই নির্ভর করছে কোন ধরণের চিকিৎসা নিতে হবে।
চিকিৎসাঃ 
প্রথম কথা,কোনও ল্যাবরেটরি টেস্ট আপনার এই সমস্যাকে ধরতে পারবে না। স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত মানুষের স্নায়ুতাত্ত্বিক অস্বাভাবিকতার যে লক্ষণগুলো ওপরে বলা হয়েছে, সেগুলোই দেখা দিলেই বুঝতে হবে আপনি একজন স্কিজোফ্রেনিয়াক। এছাড়াও মনস্তত্ত্বিক কিছু পরীক্ষায় একজন স্কিজোফ্রেনিয়াকের কিছু ঘাটতি ধরা পড়ে। যেমন – মনোযোগে অভাব,দুর্বল স্মৃতি শক্তি ইত্যাদি।
১ – ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপির (ECT) মাধ্যমে ইলেকট্রিক কারেন্ট পাস করানো হবে আপনার মস্তিস্কে। যেটা আপনার মস্তিস্কে এক ধরণের পরিবর্তন আনবে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই এখানে। একজন অভিজ্ঞ ও পেশাদার মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ একাজটি করবেন।  আগে তিনি রুগীকে যাচাই করে নিবেন কোন ধরণের থেরাপি তার দরকার। দেখা যায় একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর এই শক থেরাপি ছাড়া এটা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আর কোনও উপায় থাকে না। কিন্তু এটাকে পজিটিভলি নিন। আপনি এখনও সেই ডাইনোসর যুগে বাস করছেন না  যে চিন্তা করবেন ‘শক নিতে হবে? তার মানে আমি কি পাগল?’ এহেন চিন্তা ঘুণাক্ষরেও মাথায় আনবেন না। নিজের ভাল থাকাটা আসলে নির্ভর করছে আপনার নিজের ওপরেই।
২ – পেশাদার গ্রুপ ডিসকাশান/ কাউন্সেলিং/টক থেরাপি কাজে দেয় মাঝে মাঝে। কিন্তু সেটা নির্ভর করছে অসুখটি কোন পর্যায়ে রয়েছে তার ওপরে। এক্ষেত্রে পরিবারের একটা বড় ভুমিকা রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় পরিবারের সাপোর্ট পায় না অনেকে। অনেকে বাসায় জানাতেই পারে না/অনেকে চায় না। আর ভুলটা এখানেই করে। অনেকে ভয় পায় কাউন্সেলিং করাতে। একটা কথা মাথায় রাখবেন ‘ যেটা আপনাকে ভাল রাখবে সেটা আপনি করবেন। পাছে লোকে কি বলে/মানুষের চিন্তা আপনাকে নিয়ে সেটা কখনই আপনাকে ভাল রাখতে পারে না।’
৩ – আরেকটি চিকিৎসা হচ্ছে ওষুধ! কিছু অ্যান্টি সাইকোটিক ড্রাগ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিলে অসুখটি সেরে যায়।
আবারও বলছি সুস্থ থাকাটা আপনার নিজের ওপরে। যদি আপনার সন্দেহ হয় আপনি একজন স্কিজোফ্রেনিয়াক, দয়া করে দেরী করবেন না। বাসায় জানান। পরিবার থেকে কিছু লুকাবেন না। তাদের সাথে আলোচনা করে একজন অভিজ্ঞ ও পেশাদার মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ কিংবা মনোবিদের শরণাপন্ন হন।

@Courtesy: Shuvro Bhaia

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন