বুধবার, ১৪ মার্চ, ২০১২

আমার বন্ধু রাশেদ


পৃথিবীর নানা দেশে যুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে, হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বহু চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। যার সংখ্যা একেবারেই কম নয়। এসব ছবির সবই মানসম্পন্ন হয়েছে সেটা বলা যাবে না। এ ধরনের ছবিগুলো বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে নয় বরং নির্মিত হয় ইতিহাস ও জাতির প্রতি সকলের দায়বদ্ধতার কারণে। তেমনি একটি অলোচিত মুক্তিযুদ্ধভিক্তিক শিশুতোষ চলচ্চিত্র আমার বন্ধু রাশেদ। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের কিশোর উপন্যাস অবলম্বনে মুক্তিযুদ্ধের এই শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। সরকারি অনুদানের এ ছবিটি যৌথভাবে প্রযোজনা করেছে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড ও মনন চলচ্চিত্র। চিত্রনাট্য করেছেন মোরশেদুল ইসলাম ও বরকত উল্যাহ মারুফ। ছবিটি পরিচালনা করেছেন মোরশেদুল ইসলাম। ছবিটিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেনঃ চৌধুরী জাওয়াতা আফনান রাশেদ, রাইসুল ইসলাম আসাদ-বড় ইবু, হোমায়রা হিমু -অরু আপা, পারভেজ মুরাদ -শফিক ভাই, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় -ইবুর বাবা, ইনামুল হক - স্কুল শিক্ষক, কেরামত মওলা, ওয়াহিদা মল্লিক জলি -ইবুর মা, ইবতেশাম চৌধুরী, রিফায়েত জিন্নাত, ফাইয়াজ বিন জিয়া, লিখন রাহি, কাওসার আবেদীন, কাজী রায়হান সোকাহান সহ আরও অনেকে।


ট্রেন চলছে খুব দ্রুত গতীতে, লাইন ছুয়ে চলে যাচ্ছে কোন একটি গন্তব্যে। ট্রেনের কামড়ায় বসে গল্প করছেন দুই প্রজম্মের দুজন বাবা ও ছেলে। একজন মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহন করেছেন এবং আরেকজন এ প্রজম্মের, যার কাছে মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে গল্পের মতো। বয়স্ক ইবু (রাইসুল ইসলাম আসাদ) তার ছেলেকে নিয়ে ফিরে যায় গ্রামে ১৯৭১ সালে ইবু যে শহরে ছিল অর্থ্যাৎ দিনাজপুরে। ট্রেন যতোই এগিয়ে চলছে ইবু ততোই কল্পনাপ্রবন হয়ে উঠছে। ইবুর মনে পড়ে যাচ্ছে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় তাঁর কয়েকজন বন্ধুদের কথা। এ প্রজম্মের ইবুর ছেলের সাথে ইবু বলে যায় সে দিনগুলোর কথা। প্রসঙ্গক্রমেই চলে আসে একটি নাম রাশেদ। ইবু ব্যাখ্যা করে কিভাবে লাড্ডু নামের ছেলেটির নাম রাশেদ হলো। বয়সে কিশোর কিন্তু মনে কিসের যেনো একটি নেশা, চোখে স্বপ্ন, বুকে সাহস এবং মাথায় রাজনীতি এই হচ্ছে কিশোর রাশেদ। ইবু বলতে থাকে রাশেদ এবং তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা। ছবিটি মূলত একটি ছোট ছেলের চোখে দেখা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। প্রেক্ষাপট মফস্বলের একটা ছোট শহর। কয়েকজন স্কুলছাত্রকে ঘিরে ছবিটির কাহিনী। মূল চরিত্র রাশেদ হঠাৎ করে স্কুলে হাজির হয়। প্রথমে রাশেদের নাম থাকে লাড্ডু! তারপর স্কুলের স্যার এবং ছাত্ররা মিলে রাশেদ নাম দিলো রাশেদ। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলো যখন ছোট ছোট ছেলেরা বুঝতে পারছে না, রাজনীতি সচেতন রাশেদ তখন ঠিক তার মতো করে সেটা সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছে একসময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং একদিন এই ছোট শহরেও তারা এসে হাজির হয়আর তাদের সাথে যোগ দেয় পাকিস্তানি দালাল রাজাকাররা। ভয়ংকর এক ধ্বংসলীলার সাক্ষী হয়ে থাকে রাশেদস্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুতে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে সেসঙ্গে থাকে তার কয়েকজন বন্ধুসম্মুখযুদ্ধে বন্দী হয়ে যায় তাদের পরিচিত একজন মুক্তিযোদ্ধাএকদিন রাশেদ ও তার বন্ধুরা তাকে মুক্ত করে নিয়ে আসে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে কিন্তু যুদ্ধের ডামাডোলে রাশেদ ও তার বন্ধুদের একসময় বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হয়রাশেদ আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে যুদ্ধেদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সব বন্ধু যখন আবার একত্র হয় ছোট্ট শহরটিতে, তারা আবিষ্কার করে রাশেদ নামের বিচিত্র ছেলেটি আর নেইকিন্তু রাশেদের স্মৃতি তার বন্ধুদের হূদয়ে বেঁচে থাকে চিরদিন

তবে, এই সিনেমার দৃশ্য গুলো একদম বাস্তবভাবে ফুটে উঠেছে। দৃশ্য গুলো খুবই সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কখনো হাসিয়েছে আবার কখনো কাঁদিয়েছে। প্রদীপরা শহর ছেড়ে যাবার সময় প্রদীপ ইবু’কে জরিয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,আজকে থেকে আমরা বাস্তুহারা। আমাদের আর কোনো ভিটমাটি রইলোনাআর কোনোদিন তোর সাথে দেখা হবে কি না জানি না!" তখন মনের অজান্তেই চোখের কোণে পানি জমে উঠলো। আর ছবিটিতে সবচেয়ে মজা লেগেছে, পাকিস্তানি দালাল রাজাকার আরজফ আলীকে লিখা আজরাইলের চিঠিটা। চিঠি পেয়ে আরজফ আলী ভয়ে আর ঘর থেকে বের হয় না!! এছাড়া রাজাকার আরজফ আলীকে ‘হেই পাকিস্তানি দালাল- পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা তোকে গুলো করে মারবে’ এই কথা বলে দৌড়ে পালিয়ে গেলো রাশেদ। কিছুক্ষণ ছুটে পালিয়ে রাশেদ আবার হাঁটতে থাকে স্বাভাবিকভাবে। অন্যদিকে রাজাকার দু’জন রাইফেল হাতে আরজফ আলীর দিকে আসছে। রাজাকারদের দেখে আরজফ আলী মুক্তি বাহিনী মনে করে চিৎকার করে ছুটতে লাগলো। কয়েকবার হোঁচট খেয়েও পড়ল। তারপর, হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে, বাবারা আমাকে মাফ করে দাও! হঠাৎ করে আরজফ আলী নিজের ভুল বুঝতে পেরে প্রচণ্ড রাগে লাল হয়ে গেছে। তাকে ঘিরে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। সে সকলের মাঝে ঐ বাচ্চা ছেলেটাকে খুঁজছে। যদিও রাশেদ তার নাকের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলও। না দেখতে পেয়ে কতক্ষণ চেঁচামেচি করে চুপ হয়ে গেলো। আরজফ আলী মারাত্মক ভয় পেয়েছে। যদিও, মৃত্যু ভয় বলে কথা। তারপরে খুব হাসি পেয়েছে আরজফ আলীর কাণ্ড দেখে।

ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে ১৯৭১-এর ওই রক্তাক্ত দিনগুলোতে ফিরে গেলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই দৃশ্য। চারদিকে বোমা এবং গুলির শব্দ। প্রতিটি দিন শুরু হতো গুলির ঝংকারে  নয়তো এখানে সেখানে পড়ে থাকা লাশ কুকুর এবং শকুনে ছিঁড়ে খাওয়ার দৃশ্য দেখে। অবরুদ্ধ ছিল সারা দেশ, অবরুদ্ধ ছিল মুক্ত বাতাস নেয়ার। এভাবে দীর্ঘ নয় মাস। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় লাভ করি। এই যুদ্ধে আমাদের হারাতে হয়েছে অনেক কিছু। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের জীবন বাজি রেখেছে তবেই স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়ের অনেক স্মৃতি এখনকার সময়ের তরুণদের কাছে অজানা। অনেকেই সঠিক ইতিহাস জানে না। যতটুক জানে ততটুকুও তাদের কাছে ঘোলাটে। তারা জানার চেষ্টা করে সেই সময়ের স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের দেশে অনেক ছবি নির্মিত হয়েছে। কিন্তু শিশুতোষ মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র তৈরি করতে তেমন দেখা যায়নি। আর তাই নতুন প্রজন্মের জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধে শিশু-কিশোরদের বীরত্বগাথা তুলে আনার জন্যই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়। 


http://www.youtube.com/watch?feature=player_embedded&v=dWZ9Emffl4Yআমার বন্ধু রাশেদ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন